ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ার এক চেয়ারম্যানসহ ২৫৫জন ইয়াবা কারবারির নতুন তালিকা প্রকাশ

আরিফুজ্জামান তুহিন, দৈনিক বাংলা :: সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার করা ইয়াবা পাচারকারীদের নতুন খসড়া তালিকায় কক্সবাজারের সাবেক এমপি ও তার পরিবারের কেউ নেই। ২৫৫ জনের নতুন তালিকা থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এই নেতা, তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা বাদ পড়েছেন।

এর আগে করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবার গডফাদারদের তালিকায় বদিসহ তার পরিবারের ১০ জনের নাম ছিল। সেখানে নাম ছিল ১৫ পুলিশ সদস্যের, তাদের নামও এবারের তালিকায় নেই।

এবারের তালিকায় পৌরসভার চারজন কাউন্সিলর রয়েছেন, আছেন দুই সাংবাদিক। চার কাউন্সিলরের মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের, দুজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২৫৫ জন ইয়াবা কারবারির মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ৪৮ জন বিএনপির ও দুজন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

সরকারের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা মিলে কক্সবাজারের ইয়াবা পাচারকারীদের যে প্রাথমিক তালিকা করেছে সেই সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ইয়াবা বড়ি পাচারকারীদের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুতকারী গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে যারা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। অনেকে ইয়াবা ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন।

তারা বলছেন, কক্সবাজারের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমার অংশে ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে এসব ইয়াবা বড়ি যখন বাংলাদেশে আসে, তখন মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকায় প্রতি পিস বিক্রি হয়। সেই ইয়াবা ঢাকাসহ দেশের অন্য এলাকায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয়ে থাকে। ফলে পুরোনোরা ইয়াবা ব্যবসা বাদ দিলেও নতুন করে অনেকে এই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। এবারের তালিকায় নতুন করে অনেকের নাম এসেছে, অনেকে বাদ পড়েছেন।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, নতুন ২৫৫ জনের যে তালিকার কথা বলছেন সেটা আমার জানা নেই। মাদক নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থাই এমন তালিকা করে থাকে।

তিনি বলেন, সাধারণত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিয়মিত তালিকা হালনাগাদ করে। মূলত মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা তালিকা করে পাঠান। পরে সেই তালিকা একটি কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাতে সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়।

২৫৫ তালিকার গুরুত্বপূর্ণ যারা

সরকারের বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ইয়াবা পাচারকারী ২৫৫ জনের যে তালিকা করেছে তাতে দিনমজুর যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন তাদের নেতৃত্বদানকারী বড় পাচারকারীরাও।

তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কক্সবাজারের দক্ষিণ রুমালিয়াছড়ার শাহানবাড়ির মো. নুরুকে তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে। নুরুর বাড়ি সেখানকার পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে। নুরুর একাধিক ট্রলার আছে, যার মাধ্যমে তিনি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বড়ি নিয়ে আসেন। তার ইয়াবা বিক্রির প্রধান ক্ষেত্র কুমিল্লা। এরপর সেখান থেকে এই মাদক দেশের অন্যান্য অঞ্চলে চলে যায়। আর কুমিল্লা থেকে তিনি ফেনসিডিল নিয়ে কক্সবাজারে বিক্রি করেন। তার নামে একাধিক মামলা আছে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।

কক্সবাজার সদর থানা রোডের আলী ম্যানশনে থাকেন মোহাম্মদ আলী। তালিকার দুই নম্বরে থাকা আলী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একসময় দরিদ্র থাকলেও ইয়াবা ব্যবসা করে এখন কোটিপতি। তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলার তথ্য খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা। মোহাম্মদ আলীকে কক্সবাজারের ইয়াবা গডফাদারদের অন্যতম বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

দক্ষিণ রুমালিয়াছড়ির শাহানবাড়ির বাসিন্দা মিজান ইয়াবা পাচারকারী তালিকায় আছেন চার নম্বরে। একসময় জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মিজানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তার একাধিক ট্রলার রয়েছে, যার মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে তিনি সাগরপথে ইয়াবা আনেন। ইয়াবা পাচারকারী তালিকার এক নম্বরে থাকা মো. নুরুর আপন ভাই মিজান।

তালিকায় পাঁচ নম্বরে আছেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ওমর ফারুক সোহাগ। কক্সবাজার সদরের এই বাসিন্দার বিরুদ্ধে একাধিক মামলার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। প্রতিবেদনে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, সোহাগের কাছে ‘এমএম নাইন’ মডেলের একটি পিস্তলও রয়েছে।

জনপ্রতিনিধিদেরও নাম আছে

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এস আই এম আক্তার কামাল আজাদের নাম আছে ইয়াবা পাচারকারীর তালিকায়। প্রতিবেদনে তাকে বিএনপি নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ছাত্রদলের সাবেক নেতা বর্তমানে জেলা কৃষক দলের সভাপতি জামসেদ আলীর নামও আছে এই তালিকায়। আশরাফুল হুদা ছিদ্দিকী জামশেদ বর্তমানে কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তবে বিএনপির এই দুই নেতা ও জনপ্রতিনিধির নামে মাদক-সংক্রান্ত মামলার কোনো তথ্য পাননি গোয়েন্দারা।

ইয়াবা তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে এস আই এম আক্তার কামাল আজাদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো কীভাবে হলো আমি জানি না। শত্রুতা করে কেউ নাম দিতে পারে। আমার এলাকায় আমি ইয়াবার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত।’

আশরাফুল হুদা ছিদ্দিকী জামশেদ আলী কাতারে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সাহাব উদ্দিন সিকদার কক্সবাজার পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের দুজনের নামই আছে ইয়াবা পাচারকারীর তালিকায়। তাদের বিরুদ্ধে মাদক মামলার কোনো তথ্য পাননি গোয়েন্দারা।

মিজানুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কল করা হয়, তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে সাহাব উদ্দিন সিকদার টেলিফোনে বলেন, ‘আমার পক্ষে-বিপক্ষে লোক থাকতে পারে। তারা এই নাম দিয়েছে মনে হয়। আমি কোনো দিন ইয়াবা খাইনি, ধরিওনি। ইয়াবার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জমিদার পরিবারের সন্তান, আমার সহায়সম্পদ কম নেই, সেখান থেকে আসা আয়ে আমার দানখয়রাত করে ভালো চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমার জায়গার ওপর সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস। সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার হতো, আমি নিজে হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়েছি। আমি কীভাবে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকি বলেন?’

কক্সবাজারের কোনাখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান দিদারুল হক শিকদারের নামও আছে ইয়াবা পাচারকারীর তালিকায়। তবে তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা নেই।

বড় গডফাদার আব্দুল্লাহর নামে মামলা নেই

কক্সবাজারের টেকনাফ সদরের গোদারবিলের আবু সৈয়দ মেম্বারের ছেলে আব্দুল্লাহর বয়স মাত্র ৩২। এর মধ্যে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করে। তাকে এখনই ইয়াবার বড় গডফাদার বলা হয়ে থাকে। অজ্ঞাত কারণে তার নামে মাদকের কোনো মামলা নেই। টেকনাফে ‘আবদুল্লাহ কটেজ’ নামে একটি হোটেল আছে। সেখানে ইয়াবা লেনদেন হওয়ার তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের পাশে সমুদ্রসৈকতে গড়ে ওঠা অবৈধ বেশ কিছু ঝুপড়িঘরের মালিকও এই আব্দুল্লাহ।

রেহাই পেলেন বদি ও তার ঘনিষ্ঠরা

মাঠপর্যায়ে পুলিশ, সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও মাদকের গোয়েন্দারা মিলে একটি তালিকা পরপর বেশ কয়েক বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছিল, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা হিসেবেও পরিচিত। সর্বশেষ ওই তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে। ওই তালিকা ও তার আগে করা সব তালিকায় কক্সবাজার-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমান বদিকে দেশের এক নম্বর ইয়াবা গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব তালিকায় বদির ঘনিষ্ঠ নয়জনও ছিলেন। এর মধ্যে বদির পাঁচ ভাই মো. আব্দুস শুক্কর, আব্দুল আমিন, মৌলভি মজিবুর রহমান, মো. শফিক ও মো. ফয়সাল ছিলেন। তালিকায় আরও ছিলেন বদির ভাগ্নে শাহেদুর রহমান নিপু, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল এবং বেয়াই আক্তার কামাল ও শাহেদ কামাল।

গণমাধ্যমে এই তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর ক্ষমতাসানী দলের ভেতরেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন আব্দুর রহমান বদি। সে সময় তিনি অবশ্য গণমাধ্যমের কাছে তার নাম আসার বিষয়ে বলেছিলেন, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করেই এই নাম দিয়েছে। এবারের মাঠপর্যায়ে করা তালিকায় বদি ও তার ঘনিষ্ঠ ওপরের নয়জনের কারোরই নাম নেই।

তালিকায় পুলিশের নাম নেই

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গতবারের সর্বশেষ তালিকায় ১৫ জন পুলিশ সদস্যের নাম ছিল। তবে এবার মাঠপর্যায়ে করা তালিকায় একজন পুলিশেরও নাম নেই। আগের তালিকায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহকারী পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার চারজনের নাম ছিল। এবারের তালিকায় কোনো ডিবি সদস্যের নাম নেই।

মিয়ানমার থেকে আসা মাদক ইয়াবার প্রধান রুট টেকনাফ ও উখিয়া থানায় প্রায় ৩৭টি পয়েন্ট রয়েছে। এর আগে করা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পাঁচ কর্মকর্তার নাম ছিল। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ওই তালিকায় নাম ছিল পাঁচ কর্মকর্তার নাম। এ ছাড়া হোয়াইংকং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের নামও ছিল। অবশ্য এদের কেউ এখন আর কক্সবাজারে নেই, অনেকের বিভাগীয় শাস্তিও হয়েছে।

পাঠকের মতামত: